Ads

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কি ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে

 

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকোলাজ

কয়েক মাসের অচলাবস্থার পর অবশেষে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি (‘ই-থ্রি’ নামে পরিচিত) ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া আনুষ্ঠানিক নোটিশে এ তিন দেশ জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘কূটনৈতিক সমাধান’ চায়। নোটিশে বলা হয়, এ নোটিশ দেওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধানে ই-থ্রি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী, চুক্তির এক বা একাধিক পক্ষ যদি মনে করে, ইরান বড় ধরনের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, তবে তারা নিরাপত্তা পরিষদকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে পারে। এভাবে ‘স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া’ শুরু হয়।

ওই অবগতির ৩০ দিনের মধ্যে সমাধান না হলে ধাপে ধাপে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাগুলো ফিরে আসে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ইরানের অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, জাহাজ চলাচল, কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এ সিদ্ধান্ত ভেটো–প্রতিরোধী, অর্থাৎ কোনো দেশ চাইলে এককভাবে এটি ঠেকাতে পারবে না।

আইআরজিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য আরও বড় আঘাত হতে পারে। কারণ, অর্থনীতির বহু খাত তাদের নিয়ন্ত্রণে। শত শত প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে যুক্ত। ফলে আইআরজিসির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা মানে গোটা ইরানের অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা।

সম্প্রতি ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় ই–থ্রি তিনটি শর্ত দিয়েছিল, যাতে ‘স্ন্যাপব্যাক’ কার্যকর না হয়। শর্তগুলো হলো ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় ফিরে আসে; আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) যেন আবার ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়, যা দেশটির সঙ্গে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ১২ দিনের সংঘাতের পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং আইএইএ ইরানে যে ৪০০ কেজির বেশি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব থাকার কথা জানিয়েছে, তেহরানকে তার পূর্ণ হিসাব দিতে হবে।

আরও পড়ুন

সব নিষেধাজ্ঞাই ইরানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বিশ্লেষকেরা তিনটি নিষেধাজ্ঞাকে সবচেয়ে গুরুতর মনে করছেন। তা হলো তেল-গ্যাস খাতে নতুন বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা এবং ‘১৬৯৬ নম্বর প্রস্তাব’ পুনর্বহাল, যা ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি বন্ধ করতে বাধ্য করে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের বিষয়টিই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় অচলাবস্থা তৈরির কেন্দ্রে রয়েছে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি

ইরানের তেল-গ্যাস খাত তার অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কিন্তু তেল–গ্যাসের উৎপাদন কমছে, প্রযুক্তি পুরোনো হয়ে যাচ্ছে, আর দেশি চাহিদা বেড়ে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্র ইরানের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৪ শতাংশ) জ্বালানির জোগায়। কিন্তু চাপ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ–সংকট বেড়েছে।

যদি ‘স্ন্যাপব্যাক’ সক্রিয় হয়, তবে আইএইএর সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা পুরোপুরি থেমে যাবে।
কাজেম ঘারিবাবাদি, ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী

ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী চার বছরে প্রতিবছর ১৯ বিলিয়ন (১ হাজার ৯০০ কোটি) ডলার বিনিয়োগ দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে অন্য দেশগুলো ইরানে অর্থ লগ্নি করছে না। ফলে একমাত্র রাশিয়া ও চীনই এ অর্থ দিতে সক্ষম এবং হয়তো আগ্রহীও হবে। দেশ দুটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারলেও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা তাদের মানতে হতে পারে। কারণ, অতীতে তারাও এ ধরনের প্রস্তাব সমর্থন করেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে নিষেধাজ্ঞা প্রকাশ্যে অমান্য করার ঝুঁকি নেবে না।

আইআরজিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য আরও বড় আঘাত হতে পারে। কারণ, অর্থনীতির বহু খাত তাদের নিয়ন্ত্রণে। শত শত প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে যুক্ত। ফলে আইআরজিসির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা মানে গোটা ইরানের অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা।

চীন ইরানের মোট তেলের ৯০ শতাংশ কেনে। কিন্তু আইআরজিসি ইরানের প্রায় অর্ধেক তেল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে চীনও কেনা কমাতে বা বন্ধ করতে পারে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, আইআরজিসি ইরানের তেল বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যদি এনপিটি থেকে সরে যায় কিংবা আইএইএর সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, তবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গোপন কর্মসূচিতে রূপ নেবে। এতে আঞ্চলিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। তুরস্ক ও সৌদি আরব এতে সবচেয়ে আগে যোগ দেবে।

আইআরজিসির ওপর নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক খেসারত হবে মারাত্মক। এমন নিষেধাজ্ঞার জেরে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমবে, রিয়াল আরও অবমূল্যায়িত হবে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে। ফলে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

রাজনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতি ভয়ানক হতে পারে। আইআরজিসির ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা এ বাহিনীকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও একঘরে করবে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশ তাদের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করতে পারে। ইরানে শাসনব্যবস্থা টিকে থাকা যেখানে আইআরজিসির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এটি (নতুন করে নিষেধাজ্ঞা) ইরানের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আরও পড়ুন

সবচেয়ে বড় আঘাত আসতে পারে ১৬৯৬ নম্বর প্রস্তাব থেকে। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে গৃহীত এ প্রস্তাবে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ পুরোপুরি বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এ–সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নকাজও। অথচ ইরান সব সময় দাবি করেছে, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (এনপিটি) অনুযায়ী সমৃদ্ধকরণ তাদের অধিকার। রাশিয়া ও চীনও সমর্থন করেছিল ওই প্রস্তাব, অর্থাৎ এখানে ইরানের পক্ষে দাঁড়ানোর সুযোগ কম।

একটাই সমাধান আছে, ইরানের সমৃদ্ধকরণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এর আগে নির্দিষ্ট সময় (সম্ভাব্য দীর্ঘ সময়) পর্যন্ত, যেটি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সবাই মেনে নেবে; ইরানকে তা (অধিকার) প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে (ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ রাখা) হবে।
কাসেম মোহেবালি, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক মহাপরিচালক

এ নিষেধাজ্ঞা ইরানের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ভেঙে দেবে। ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন (১ লাখ ২০ হাজার কোটি) ডলার। তবু সরকার সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে গেছে। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ বেড়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপের ঝুঁকিও বেড়েছে।

তাই স্ন্যাপব্যাক শুধু অর্থনীতিকে নয়, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির রাজনৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তিও নাড়িয়ে দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইটে তোলা ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনার দৃশ্য। কোম, ইরান, ২০ জুন ২০২৫ (বাঁয়ের ছবি) ও ২২ জুন ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইটে তোলা ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনার দৃশ্য। কোম, ইরান, ২০ জুন ২০২৫ (বাঁয়ের ছবি) ও ২২ জুন ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

বিপজ্জনক উত্তেজনার সম্ভাবনা

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য ইউরোপীয় ওই তিন দেশের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, এ তিন দেশের তথাকথিত স্ন্যাপব্যাক–ব্যবস্থায় যাওয়ার কোনো আইনি বা নৈতিক অধিকার নেই।

তবে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করলেও সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা দুটি বড় পদক্ষেপ নিতে পারে—এনপিটি থেকে সরে যাওয়া এবং আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ করা।

আরও পড়ুন

এ সপ্তাহে ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজেম ঘারিবাবাদি সতর্ক করে বলেন, ‘যদি এমন পদক্ষেপ (স্ন্যাপব্যাক) সক্রিয় করা হয়, তবে আইএইএর সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা পুরোপুরি থেমে যাবে।’

আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া হতে পারে এনপিটি থেকে ইরানের বেরিয়ে যাওয়া। দেশটির কিছু আইনপ্রণেতা এ বিষয়ে জরুরি বিল খসড়া করছেন বলে জানা গেছে। কট্টরপন্থী রাজনীতিবিদ, বিশেষত পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কমিটির সদস্য আইআরজিসির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কোসারি বারবার এ দাবি তুলেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যদি এনপিটি থেকে সরে যায় কিংবা আইএইএর সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, তবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি গোপন কর্মসূচিতে রূপ নেবে। এতে আঞ্চলিকভাবে পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। তুরস্ক ও সৌদি আরব এতে সবচেয়ে আগে যোগ দেবে। সবচেয়ে ভয়ানক পরিণতি হলো ইসরায়েল ইরানের ওপর ভয়ংকর হামলা চালাতে পারে, যা আগের যেকোনো আক্রমণের চেয়ে অনেক কঠিন এবং যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

যদি ইসরায়েল এবার ইরানে সরকার পতনের লক্ষ্যে আক্রমণ চালায়, তবে দেশটির প্রতিক্রিয়া হবে সর্বোচ্চ মাত্রার।

তাহলে ইরান সরাসরি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে। একই সঙ্গে হরমুজ প্রণালি অরক্ষিত বা অচল করার চেষ্টা করতে পারে। এতে বিশ্ববাজারে দৈনিক ব্যবহৃত ১০ কোটি ব্যারেলের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি সংঘাতকে এক নতুন, ভয়ংকর স্তরে নিয়ে যাবে।

সমাধানের একমাত্র পথ

স্ন্যাপব্যাক–ব্যবস্থার ফলের বিপর্যয়কর এমন পরিস্থিতি এড়াতে হলে, বিশেষ করে সর্বনাশা যুদ্ধের ঝুঁকি ঠেকাতে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ছেড়ে দেওয়াই একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এটাই আজকের সংকটের মূল কেন্দ্রবিন্দু।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক মহাপরিচালক কাসেম মোহেবালি সমাধানের একটি পথ দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘একটাই সমাধান আছে, ইরানের সমৃদ্ধকরণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এর আগে নির্দিষ্ট সময় (সম্ভাব্য দীর্ঘসময়) পর্যন্ত, যেটি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সবাই মেনে নেবে; ইরানকে তা (অধিকার) প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে (ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ রাখা) হবে।’

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!