চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে পর শিক্ষায় সংস্কার সবচেয়ে প্রত্যাশিত জন–আকাঙ্ক্ষা হলেও এ খাতে সংস্কারের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। বরং এবারের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ শিক্ষায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের মধ্যে বরাদ্দের বৃত্তে আটকে আছে। অথচ একটি দেশের জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে যে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক, তার জন্য এ খাতে জিডিপির অন্তত ৫–৬ শতাংশ ব্যয় করা প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরির জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ নিয়ে সরকারগুলোর ধারাবাহিক অবহেলা ও ব্যর্থতার প্রতিফল আমরা পেতে শুরু করেছি। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—শিক্ষার সব স্তরে যে হারে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, সেটা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অভিযাত্রার সঙ্গেও তা সাংঘর্ষিক।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির (এপিএসসি) বরাতে প্রথম আলো জানাচ্ছে, দেশে এক বছরের ব্যবধানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হারে অবনতি হয়েছে। শুমারির তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে প্রায় চার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় বেড়েছে, যার সব কটিই বেসরকারি বিদ্যালয়। এই সময়ে শিক্ষার্থীও বেড়েছে প্রায় দুই লাখ। এ তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে শিক্ষার্থীরা আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরছে। কিন্তু একই সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়াটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুরা তাহলে কোথায় পড়বে?
সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০ সালে যেখানে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ শতাংশের বেশি, সেটা ২০২৩ সালে নেমে আসে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশে। ২০২৪ সালে সেটা বেড়ে আবার ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার এই উল্টোযাত্রা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করা জরুরি। এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক শঙ্কা প্রকাশ করেছিল, এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিদরিদ্র হবে। এর পেছনে সংস্থাটি ক্রমাগত প্রকৃত আয় কমে যাওয়া; দুর্বল শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মন্থরগতিকে দায়ী করেছিল।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, গত তিন বছরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ছেলেদের ঝরে পড়ার হার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে এই হার যেখানে ছিল ১৪ শতাংশ, এক বছরের ব্যবধানে সেটি বেড়ে ১৯ শতাংশ হয়েছে। দারিদ্র্যের কারণে শিশুদের একটি অংশ শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটাও এখানে খুঁজে বের করা জরুরি। আবার ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। ফলে দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চলে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা যে বেশি, সেটা স্পষ্ট।
সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক–সংকটও গ্রাম এবং দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়বিমুখ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বলে আমরা মনে করি। অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের তুলনায় নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়াটা দুঃখজনক। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার উল্টোযাত্রা আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্য অশনিসংকেত। অনিশ্চয়তা কাটিয়ে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় ফেরানো না গেলে দারিদ্র্য ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। সরকারকে অবশ্যই শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।