Ads

ফ্যাসিবাদের মানদণ্ডে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামল

 

ফ্যাসিবাদের মানদণ্ডে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামল

আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি প্রায়ই আলংকারিক গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু যখন ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকে এ আয়নায় ফেলা হয়, তখন এটি আর গালি থাকে না, হয়ে ওঠে একটি কাঠামোগত ও তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ। বেনিতো মুসোলিনি, অ্যাডলফ হিটলার ও পল পটের রাষ্ট্র পরিচালনার মডেলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতির তুলনা করলে যে সাদৃশ্য ফুটে ওঠে, তা যুগপৎ বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক।

ফ্যাসিবাদকে বুঝতে হলে এর তাত্ত্বিক কাঠামো জানা জরুরি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট প্যাক্সটনের মতে, ফ্যাসিবাদের কয়েকটি মূল স্তম্ভ হলো একনায়ক বা নেতার অন্ধ অনুকরণ (লিডার কাল্ট), সহিংস দলীয় মিলিশিয়া বাহিনীর উপস্থিতি, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ তৈরি করা, আইনের শাসনকে ‘আইনের দ্বারা শাসনে’ পরিণত করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেতর থেকে ফাঁপা করে দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারণাকে ভীতি ও দমনের হাতিয়ার বানানো। চলুন, এই মানদণ্ডগুলো দিয়েই গত দেড় দশকের আওয়ামী শাসনকে বিচার করা যাক।

এক নেতা, এক রাষ্ট্র—ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি

ফ্যাসিবাদের প্রথম শর্তই হলো নেতা ও রাষ্ট্রকে সমার্থক করে তোলা। মুসোলিনির দর্শন ছিল, ‘রাষ্ট্রের ভেতরেই সবকিছু, রাষ্ট্রের বাইরে বা বিরুদ্ধে কিছু নয়’। হিটলারের ‘ফিউরার প্রিন্সিপ’ অনুযায়ী, নেতাই ছিলেন আইন।

বাংলাদেশে গত দেড় দশকে শেখ হাসিনাকে ‘উন্নয়নের রূপকার’ থেকে ‘মানবতার মা’—ইত্যাদি বিশেষণে মহিমান্বিত করে ব্যক্তিপূজার এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। তাঁর বা তাঁর বাবার যেকোনো সমালোচনাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা’ হিসেবে চিত্রায়িত করার প্রবণতা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক। রাষ্ট্র, সরকার ও দলকে একাকার করে ফেলার এ প্রক্রিয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর প্রথম ও প্রধান লক্ষণ।

দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী ও সিন্ডিকেট তৈরি

মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্টস বা হিটলারের এসএ বাহিনীর কাজ ছিল রাস্তায় সহিংসতা দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা। বাংলাদেশে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ভূমিকা বিভিন্ন সময়ে এই দলীয় মিলিশিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০১২ সালে বিশ্বজিৎ দাসের প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সিলেটে এমসি কলেজে গৃহবধূকে দলগত ধর্ষণ, ২০১৯ সালে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা—এ ঘটনাগুলো দলীয় সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় দেওয়ার উদাহরণ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র দলীয় কর্মীদের সহিংস আক্রমণ এই ‘ডাবল ব্যারেল’ দমন কৌশলেরই নগ্ন রূপ, যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীরাও একযোগে কাজ করেছে।

ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক মডেলেও দলীয়করণের জায়গা থাকে, যাকে ‘করপোরেটিজম’ বলা হয়, যেখানে রাষ্ট্র ও অনুগত পুঁজিপতিদের একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়। এখানে মুক্তবাজার বা সমাজতন্ত্র—কোনোটিই থাকে না; বরং রাষ্ট্র দলীয় আনুগত্যের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে একচেটিয়া সুবিধা দেয়, যা একধরনের ‘রেন্ট-সিকিং’ বা ভাড়া খাটা অর্থনীতি তৈরি করে। এর মূল উদ্দেশ্য থাকে দুটি—রাজনৈতিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য অর্থের জোগান নিশ্চিত করা এবং একটি অনুগত ধনিক শ্রেণি তৈরি করা, যারা শাসকদের ক্ষমতার অন্যতম খুঁটি হিসেবে কাজ করবে।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশে এই মডেলের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে। বিদ্যুৎ খাতে ‘কুইক রেন্টাল’ ও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানিকে শত শত কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই।

ব্যাংকিং খাতে দলীয় বিবেচনায় ঋণ দেওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটি অনুগত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়। মেগা প্রজেক্টগুলোর অস্বচ্ছ ব্যয় এবং বারবার সময় ও খরচ বৃদ্ধি ছিল এই সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম।

এ ‘উন্নয়ন-বয়ান’ আসলে ছিল একটি ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির আবরণ, যার ভার বহন করেছে সাধারণ জনগণ, আর মুনাফা লুটেছে ক্ষমতার সঙ্গে আঁতাতকারী গোষ্ঠী।

‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ নির্মাণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ

ফ্যাসিবাদ টিকে থাকে ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’ বিভাজনের ওপর। হিটলারের জার্মানিতে ইহুদিরা ছিল ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’, একইভাবে পল পটের কম্বোডিয়ায় ‘শহুরে বুদ্ধিজীবী’দের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংকীর্ণ দলীয় বয়ানে আবদ্ধ করে সরকারের যেকোনো সমালোচককে—তিনি ছাত্র, সাংবাদিক বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি যেই হোন না কেন—তাঁকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’, ‘রাজাকার’ বা ‘জঙ্গি’ হিসেবে চিহ্নিত করার একটি রাজনৈতিক প্রকল্প চালু ছিল। এ বিভাজনমূলক রাজনীতি সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নকে একটি নৈতিক বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।

এ অভ্যন্তরীণ শত্রু নির্মাণ নিছক কোনো রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি রাজনীতির সংজ্ঞাকেই ফ্যাসিবাদী আদলে নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রকল্প, যা নাৎসি আইনজ্ঞ কার্ল স্মিটের তত্ত্বের প্রতিধ্বনি করে। স্মিটের মতে, রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো ‘বন্ধু’ ও ‘শত্রু’র মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা।

আওয়ামী লীগ শাসন তার দেড় দশকে যেকোনো ভিন্নমতাবলম্বীকে রাষ্ট্র ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টিকারী ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে রাজনৈতিক মতবিরোধ আর সাধারণ বিষয় থাকেনি, এটি পরিণত হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে। আর যখনই কোনো গোষ্ঠী ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো মাত্রার সহিংসতা রাষ্ট্রের চোখে বৈধতা পেয়ে যায়। এটি আর রাজনীতি থাকে না, হয়ে ওঠে নিজ নাগরিকদের বিরুদ্ধে এক ‘অনন্ত যুদ্ধ’।

আরও পড়ুন

হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের মূলনীতি ছিল, ‘একটি মিথ্যাকে যথেষ্ট পরিমাণ পুনরাবৃত্তি করলে তা সত্যে পরিণত হয়।’ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র একটি বিকল্প বাস্তবতা তৈরি করে, যেখানে সরকারের বয়ানই একমাত্র সত্য। বাংলাদেশে গত দেড় দশকে মিডিয়াকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এই গোয়েবলসীয় মডেল প্রয়োগ করা হয়েছে।

একদিকে রাষ্ট্রীয় চাপ দিয়ে মূলধারার মিডিয়াকে ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’ করতে বাধ্য করা হয়েছে, অন্যদিকে সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশাল অনলাইন ‘সাইবার আর্মি’। যেকোনো সমালোচনামূলক কণ্ঠকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত আক্রমণ, হুমকি এবং মামলার মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

‘উন্নয়নের জোয়ার’-এর একরৈখিক প্রচারণার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট, গুম ও গণতন্ত্রহীনতার মতো কঠিন সত্যগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা চলেছে। এ প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে শাসকের নির্মিত এক কাল্পনিক জগতে বন্দী রাখা।

আইন হয়ে ওঠে দমনের অস্ত্র

ফ্যাসিবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো আইনের শাসনকে (রুল অব ল) আইনের দ্বারা শাসনে (রুল বাই ল) পরিণত করা। জার্মানিতে ‘এনাবলিং অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে হিটলার সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমনই এক নিপীড়নমূলক হাতিয়ার। এই আইনের অধীন হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার, হয়রানি ও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।

২০২১ সালে কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু এই আইনের ভয়াবহতার প্রতীক হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) করা হলেও এর দমনমূলক চরিত্র প্রায় অপরিবর্তিত ছিল, যা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কেবল আইন তৈরি করেই ক্ষান্ত হয় না, আইনের প্রয়োগকারী ও ব্যাখ্যাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করে দেয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা ছিল এর অন্যতম প্রধান প্রকল্প। নিম্ন আদালতকে বহু আগেই নির্বাহী বিভাগের অধীন আনা হয়েছিল এবং উচ্চ আদালতেও দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ ও চাপ প্রয়োগের অভিযোগ ছিল ক্রমাগত। প্রধান বিচারপতিকে দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো ঘটনা বিচার বিভাগের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল।

এর পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে একটি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘নিশিরাতের নির্বাচন’ ও ২০২৪ সালের ‘ডামি নির্বাচন’ প্রমাণ করে যে নির্বাচন ব্যবস্থাটি ছিল নিছকই একটি প্রহসন, যার কাজ ছিল স্বৈরাচারী শাসনকে গণতান্ত্রিক বৈধতার একটি পাতলা আবরণ দেওয়া। যখন একটি রাষ্ট্রের বিচার ও নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন জনগণের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের আর কোনো পথ খোলা থাকে না, যা অনিবার্যভাবে রাষ্ট্রকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়।

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ভয়ের সাম্রাজ্য

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ভয়কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ফ্যাসিবাদী শাসনের একটি পরিচিত কৌশল। বাংলাদেশে ‘গুম’ ও ‘ক্রসফায়ার’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, শত শত ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। এ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও এর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

নির্বাচনী প্রহসন ও গণতন্ত্রের অবসান

ফ্যাসিবাদী শাসকেরা গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতাকে বজায় রাখলেও এর আত্মাকে ধ্বংস করে দেয়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল একতরফা, যেখানে ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ‘রাতের ভোট’ বা ‘ব্যালট বাক্স ভর্তি’র অভিযোগ ওঠে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এই ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ প্রমাণ করে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেই গণতন্ত্রকে শ্বাসরোধ করা হয়েছিল।

চূড়ান্ত অধ্যায়: জুলাই-আগস্টের ‘ম্যাসাকার’

আওয়ামী লীগ শাসনের ফ্যাসিবাদী চরিত্রটি সবচেয়ে নৃশংসভাবে উন্মোচিত হয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে।
তখন যা ঘটেছিল, তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; বরং দেড় দশক ধরে তৈরি হওয়া দমনমূলক কাঠামোর যৌক্তিক পরিণতি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের ওই সময়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের একটা অংশ ছিল শিশু। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ হত্যাকাণ্ড ছিল ‘ব্যাপক ও পদ্ধতিগত’ এবং এটি ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। সারা দেশে কারফিউ জারি, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

বিবিসি আইয়ের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ফরেনসিক অনুসন্ধানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায় যে তিনি সরাসরি আন্দোলনকারীদের ওপর ‘লিথাল উইপন’ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ঘটনাগুলো পল পটের ‘শুদ্ধি অভিযানের’ কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেখানে রাষ্ট্র তার নিজের তরুণ প্রজন্মকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল অভিযানে নেমেছিল।

আরও পড়ুন

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অভিযোগপত্রে হত্যা, নির্যাতনের নির্দেশ দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে ব্যাপক ও পদ্ধতিগত হামলা চালানোর মতো গুরুতর বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট যে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনব্যবস্থা ফ্যাসিবাদের প্রায় প্রতিটি মানদণ্ড পূরণ করেছে। ব্যক্তিপূজা থেকে শুরু করে দলীয় বাহিনীর সন্ত্রাস, আইনকে দমনের হাতিয়ার বানানো, ভয়ের পরিবেশ তৈরি, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস এবং পরিশেষে রাষ্ট্রীয় মদদে সাধারণ মানুষকে ব্যাপক হারে হত্যা করা—সবই একটি সুসংহত ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের অংশ ছিল।

সুতরাং আওয়ামী লীগের শাসনকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলা কোনো রাজনৈতিক স্লোগান বা গালি নয়। এটি একটি তথ্যনিষ্ঠ, কাঠামোগত ও বিশ্লেষণাত্মক সিদ্ধান্ত, যার সপক্ষে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন, নিহত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যান এবং ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের রক্তপাত ছিল সেই প্রকল্পের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এর দায়বদ্ধতা ও বিচার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!