বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ইতিহাসে হাইকোর্টের দেওয়া রায়টি নিঃসন্দেহে এক মাইলফলক। দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্নটি আলোচিত হয়ে আসছিল—অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা কার হাতে থাকা উচিত, তার এক স্পষ্ট উত্তর দিয়েছেন আদালত। রায়ের ফলে রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে এই ক্ষমতা ফিরে যাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে, যা ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে চলে যাওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। যদিও পঞ্চম সংশোধনীতে ‘রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে’ শব্দবন্ধ যোগ করা হয়, তবু কার্যত বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অটুট ছিল। হাইকোর্ট এবার স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এটা সাংবিধানিক চেতনার পরিপন্থী এবং মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
এই রায় কেবল আইনি কাঠামো পুনর্গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে এক বড় পদক্ষেপ। সংবিধানের ২২, ১০৭ ও ১০৯ অনুচ্ছেদ এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ের নির্দেশনা উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘বিচার বিভাগ অবশ্যই নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হবে। অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত হবে। কার্যক্রম ও কাঠামোগতভাবে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের স্বাধীন অঙ্গ। স্বাধীনভাবে কাজ করতে এবং সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গ (আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ) থেকে বিচার বিভাগ পৃথক; নির্বাহীর ছাতার নিচে কিংবা মিশে কাজ করতে পারে না। পৃথক বিচার বিভাগ সাংবিধানিক অধিকার।’ সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা এমনটাই হওয়া উচিত।
তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের নির্দেশনা এ রায়ের আরেকটি যুগান্তকারী দিক। সংসদ সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মতোই বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে কাঠামোগতভাবে বিচার বিভাগ নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারবে। এতে আইন মন্ত্রণালয়ের অযাচিত প্রভাব কমবে এবং বিচারকেরা তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখবে। হাইকোর্টের এই রায় সেই সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দ্বার উন্মোচন করেছে। এটি শুধু বিচার বিভাগের জন্য নয়; বরং দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার এক নতুন আশ্বাস।
এই রায়ের ইতিবাচক দিক হলো, এটি কেবল তাত্ত্বিক স্বাধীনতার দাবি করছে না; বরং কার্যকর বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পথও দেখিয়ে দিচ্ছে। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিফলন এতে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মতামতও বলছে, এটি দক্ষিণ এশিয়ার বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দীর্ঘ মেয়াদে প্রশাসন ও আদালতের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে।
এখন এ রায় বাস্তবায়ন করতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে। প্রশাসনিক জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ কিংবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যেন এই রায়ের ইতিবাচক প্রভাবকে ক্ষুণ্ন না করে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার-উদ্যোগ এ রায়কে ভিত্তি করে এগোলে বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন হতে পারে।
আমরা মনে করি, হাইকোর্টের এই রায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রযাত্রা। এখন দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের; দ্রুত পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং সুপ্রিম কোর্টের কাছে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকার খুব বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবে না। তাই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। কোনোভাবেই তাদের ভুলে যাওয়া চলবে না, স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি।