Ads

আন্দোলন দমানোর এ কেমন ‘কৌশল’

 

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। ১৬ জুলাই, ফার্মগেট, ঢাকা
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। ১৬ জুলাই, ফার্মগেট, ঢাকাছবি: সাজিদ হোসেন

বিসিএস পরীক্ষাসহ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অন্তত দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে। ‘বাংলা ব্লকেড’ নাম দিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেলপথ তারা অবরোধ করেছে।

এটি নিঃসন্দেহে জনদুর্ভোগ বাড়িয়েছে। তবু দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাদের এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। আন্দোলনের শুরুর দিকে ছাত্রলীগও কোটা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছিল। পরে সরকারের বিভিন্ন মহলের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বক্তব্যও পাল্টাতে থাকে। কিন্তু গত দুই দিনে পরিস্থিতি এত দ্রুত পাল্টে যাবে, এটা বোধ করি কারও ধারণায় ছিল না।

১৪ জুলাই রাতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ এ ধরনের স্লোগান দেয়। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, এই স্লোগান মোটেও নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়। বরং এটি এক ধরনের ‘আয়রনি’।

রংপুরে সংঘর্ষে মারা যান কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আহত হওয়ার আগে পুলিশের গুলির সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি।
রংপুরে সংঘর্ষে মারা যান কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আহত হওয়ার আগে পুলিশের গুলির সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি।
ছবি: সংগৃহীত

মুশকিল হলো, এই স্লোগানের মধ্যে আলোচনাকে সীমিত রেখে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নৃশংস হামলাকে অনেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫-১৬ জুলাই এবং এর পূর্বাপরের ঘটনা দেখে মনে হয়, পুরো আয়োজনটি যেন পূর্বপরিকল্পিত।

এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা অতীতের যেকোনো কর্মকাণ্ডকে হার মানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাইরে থেকে আসা প্রচুরসংখ্যক দলীয় কর্মী, যাদের অনেকের মাথায় হেলমেট ছিল। তারা হকিস্টিক, লাঠি, রড, লোহার পাইপসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করে। কারও কারও হাতে পিস্তলও দেখা যায়। পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমে এসব ছবি ও ভিডিও রয়েছে।

ঘটনার সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেনি। তবে এখন দেখার বিষয়, যেসব দুর্বৃত্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হলে ঢুকে এমন তাণ্ডব চালাল—তারা যে দলের বা যে পক্ষেরই হোক—তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে এমন হামলা এটাই প্রথম নয়। কিন্তু এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন এই প্রক্রিয়ায় দমনের চেষ্টা করা হবে, এটি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ভাবতে পারেনি। পারলে প্রশাসন অন্তত ন্যূনতম ভূমিকা রাখতে পারত। হয়তো ঘটনা এত দূর ছড়াত না।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, ১৫ জুলাই তিনশর বেশি শিক্ষার্থী আহত বা গুরুতরভাবে জখম হয়েছে। ক্যাম্পাসে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে রাখায় ঘটনার নৃশংসতা তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের পক্ষেও জানা সম্ভব হয়নি। এমনকি ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা হয়েছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে পরদিন ১৬ই জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলন করতে দেখা গেছে। এ দিন আন্দোলনের ভয়াবহতায় সরকার বিভিন্ন জেলায় বিজিবি নামাতে বাধ্য হয়েছে। এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত সংঘর্ষ ও হামলায় সারা দেশে অন্তত ছয় জন মারা গেছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।

চট্টগ্রাম নগরে মুরাদপুর এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি করতে দেখা যায় এক অস্ত্রধারীকে
চট্টগ্রাম নগরে মুরাদপুর এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি করতে দেখা যায় এক অস্ত্রধারীকে
ছবি: প্রথম আলো

ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ‘লন্ডনে’। ছাত্রদলও ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর এখন দেশের স্কুল-কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

১৫ জুলাই দুপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত শিক্ষার্থীদের রাজাকার পরিচয়-সংশ্লিষ্ট স্লোগান আমাদের জাতীয় মৌলিক চেতনার সঙ্গে ধৃষ্টতার শামিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘কোটাবিরোধী কতিপয় নেতা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।’ জাতীয় মৌলিক চেতনার সঙ্গে ধৃষ্টতাপূর্ণ স্লোগান বা বক্তব্যের বিপরীতে কোন শাস্তি দেওয়া যায়, সেটি আদালতে বিচার্য হতে পারে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকে এভাবে কোনো ছাত্রসংগঠনকে ‘জবাব’ দেওয়ার কথা বলা যায় কি না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি অবশ্যই এড়ানোর দরকার ছিল। সরকারের সব পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখার সময়ে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে ওঠার প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

তাছাড়া কোন কৌশলে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে দমন করা যেত, সেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বসে পরিকল্পনার দরকার ছিল। দরকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গেও বসা, আলাপ করা। কারণ, দিনের পর দিন জনদুর্ভোগ তৈরি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অধিকার নিশ্চয় কোনো পক্ষকে দেওয়া হয়নি।

সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, কোটা সংস্কারের ব্যাপারটি আদালতের ব্যাপার, আদালতেই সমাধান হতে হবে। কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দেশের নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে সমাধান চেয়েছে। কোটা বহাল রেখে তা বাড়ানো-কমানোর এখতিয়ার সরকারের হাতে দিয়েছেন আদালত।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়তো আরও ধৈর্য ধরার প্রয়োজন ছিল। শেষ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত আসে সেটি তারা দেখতে পারত। প্রয়োজনে তখন নতুন করে আন্দোলন জমাতে পারত। তবে একই সঙ্গে বলতে হয়, সরকারি চাকরিতে বারবার কোটা সংস্কারের সুপারিশ করা হলেও সরকার কেন তা বিবেচনায় নেয়নি, সেটি জনমনে জিজ্ঞাসা।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী কিংবা পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কোটা নিয়ে কোনো পক্ষের বিরোধ নেই। মূল বিরোধ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি কিংবা তাঁদের নাতি-নাতনি কোটা নিয়ে।

এক মুক্তিযোদ্ধার বিপরীতে কত প্রজন্মের কতজনের জন্য কোটার সুবিধা রাখা হবে, সেটি এখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার। কারণ, একাত্তর সালের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার যদি চারজন সন্তান থাকেন, তবে সেই চারজনের ঘরে এখন অন্তত আটজন নাতি-নাতনি আছে ধরা যায়। তবে মানতে হবে, কোটা থাকলেও সবাইকেই কয়েক ধাপের পরীক্ষা দিয়ে চাকরির সুযোগ পেতে হয়।

হামলা-সংঘর্ষের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আরও বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, কেউ বলতে পারে না। সরকারকে এই মুহূর্তে দায়িত্বশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। কারণ, সংবাদমাধ্যম থেকেই আমরা দেখছি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যদি ছাত্র সংগঠন বা দলীয় নেতাকর্মীর হাতে তুলে দেওয়া হয়, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, সেটিও স্পষ্ট করা দরকার।

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!